BLOG Details
28 May 2020
দেশীয় পণ্যের প্রসার সহ লাখো নারী উদ্যোক্তা তৈরি করেছে 'উই'
ব্যস্ত পৃথিবী চলছিল নিজের নিয়মে। বাংলাদেশ ও তার বাইরে নয়। কারো দিকে কারো তাকানোর সময় নেই। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। নিজের ক্যারিয়ার, বাচ্চাদের স্কুল, সংসার। আত্মীয় স্বজনদের সাথে তো এক রকম সম্পর্কই শেষ বলা যেতে পারে। হঠাৎ মার্চ মাসে সব থমকে গেল। বহির্বিশ্বের মতো করোনার আবির্ভাব হল বাংলাদেশে ও। সাধারন ছুটি ঘোষণা করা হল। তখন আবার মোটামুটি অনেকেই একটু উৎসব মেজাজে আসল। এমন ঘটনা কেউ আমরা কখনোই দেখিনি। টানা ছুটি। কোন কাজ কর্ম নেই, পরিবার কে অফুরুন্ত সময় দেয়া যাচ্ছে। দিন রাতের হিসেব নেই। কিন্তু একটা সময় সবাই আস্তে আস্তে হতাশায় এসে পড়ল। আমাদের দেশের মানুষদের মাঝে একটা বড় অংশ হচ্ছে দিন আনি দিন খাই টাইপ। সেই মানুষরা পড়ল বিপদে। মানুষ অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য ও যেতে পারছে না। অফিস থেকে বেতন ও বন্ধ হয়ে গেছে। স্বামীর ও বেতন বন্ধ। এখন তো নিজের সংসার চালানোই বিপদ হয়ে গেল। অন্যদের কথা কি আর চিন্তা করবো। হতাশা গ্রাস করা শুরু করল। এমন সময় শুনলাম একটা গ্রুপে সবাই যেয়ে সবাই হতাশামুক্ত হয়ে যাচ্ছে। শুনে আমি ও যুক্ত হলাম। সেখানে শুনলাম কেউ বলছে স্কিল ডেভেলপমেন্ট এর কথা। নিজের স্কিল নিয়ে কাজ করতে বলছে। আমি তো জানতাম আমার কোন গুন নেই। কি নিয়ে কি কাজ করবো? একটা ওয়েবিনারে অংশ নিলাম। সেখানে থাকতে থাকতেই। আর তাদের কথা শুনতে শুনতেই মাথায় আসল আমি তো রান্না বান্না টা ভালই পারি। এটা নিয়ে একটু চেষ্টা করে দেখি তো। কিছু রান্না বান্নার ছবি দিয়ে পোস্ট দিলাম। নিজের পরিচয় দিয়ে নানান পোস্ট দিতে থাকি, কয়েক দিনের মাথায় আমি একটা অর্ডার পাই। প্রথম অর্ডার। খুব ভয়ে ভয়ে খাবার রেডি করলাম। আমার স্বামী আমার আই চেষ্টা দেখে বললেন, “আমি ডেলিভারি দিয়ে আসব চিন্তা করো না।“
উনারা খাবার পেলেন, খেলেন। রাত এ গ্রুপে সুন্দর এটা রিভিউ পোস্ট দিলেন। সেই পোস্টেই আরও কয়েকজন খাবার অর্ডার করলেন। চোখে পানি এসে পড়ল। স্বামীকে জড়িয়ে ধরে অনেক ক্ষণ কাঁদলাম। তারপর আর আমাকে এই কভিড টাইম এ আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আমি নিজের সংসারের হাল ধরতে পারলাম। বাচ্চার স্কুল এর ফী দিতে পারছি। স্বামী আমার কাজে সাহায্য করছে। আমি এখন হতাশা মুক্ত, অন্য দের ও হতাশা দূর করতে কাজ করছি।
এটা গেল একজন এর বাস্তব গল্প। এমন হাজার গল্প এই করোনায় তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশে অর্ধেক জনসংখ্যা নারী হলেও সেভাবে নারীদের আর্থিক অংশগ্রহন কিন্তু ছিল না নিজের সংসারের এবং পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে। এই কভিডে আমাদের নারীদের কে স্বাবলম্বী হতে শিখিয়েছে অনেক। গ্রামীণ অনেক নারী আছেন যারা ইন্টারনেট এর ব্যাবহার শিখে নিজের উদ্যোগকে কে অনলাইনে নিয়ে এসেছেন। অনেক নারী তার শোরুম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন অনেক টাকার লস গুনে। কিন্তু অনলাইনে এসে নতুন করে শোরুম খুলেছেন। লস কাভার দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আমাদের ওমেন অ্যান্ড ই-কমারস (উই) গ্রুপে যেখানে ৩০ হাজার মেম্বার ছিল মার্চ মাসে, করোনার সেটা বেড়ে হয়েছে ১০ লক্ষ। সবারই আসলে শেখার, জানার একটা জায়গা দরকার ছিল। উই সেই কাজ টা করতে পেরেছে। উদ্যোক্তা বানানোয় হাত দিয়েছে এবং শতভাগ সফল হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। ফেসবুকে ২০১৯ এর হিসেবে ৫০ হাজার বিজনেস পেজ ছিল, যেখানে ৩০ হাজার পেজ ছিল নারীদের। এখন আমরা দেখছি আমাদের উই গ্রুপে প্রায় ৪ লক্ষ নারী উদ্যোক্তা আছেন, যাদের অনেকেরই বিজনেস পেজ নেই, কিন্তু তারা উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।
একটা সময় ছিল যখন আমরা বিদেশি পণ্য ছাড়া চিন্তাই করতে পারতাম না। বিয়ে হোক বা ঈদ পুজা পার্বণ, বা অফিসের জন্য, সব খানেই আমরা বিদেশি পণ্য কে গুরুত্ব বেশি দিতাম। আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছিল। সেই জায়গা থেকে আমরা দেশীয় পণ্যের উপর প্রচার প্রচারনা শুরু করলাম। দেশীয় পণ্যের ওয়েভ শুরু করলাম। তখনি কভিড এর আক্রমন। বাইরে থেকে সব কিছু আসা বন্ধ। অনেক মানুষ তখন বাধ্য হয়ে লোকাল শাড়ী কেনা শুরু করলেন। এবং তখন বুঝলেন যে দেশি জিনিস খারাপ না। তাতের শাড়ী ও যে কত সুন্দর ডিজাইন হতে পারে এবং কত টেকসই হতে পারে তা আগে জানতেন না। আবার এমন ও সময় গেছে যে তাতিরা কোন কাজ পেতেন না, পরিবারের খাবার যোগার করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ ও বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তাতিরা হাসি মুখে কাজ ফিরিয়ে দিচ্ছেন কাজের অতিরিক্ত চাপে। মনিপুরি শাড়ী বানায় সিলেটের এক আদিবাসী তাঁতি। সেই তাতিরা এখন স্টক করার আগেই প্রি বুক হয়ে যাচ্ছে তাদের শাড়ী। এক সময় শীতল পাটির কথা আমরা তো ভুলেই গিয়েছিলাম, বাশ বেতের পণ্য, কুমিল্লার খাদি, খেশ শাড়ী ইত্যাদি। কিন্তু এখন আমরা সেই সব পণ্য কে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ। শুধু যে ফিরিয়ে নিয়ে আসছি তাই নয়, সেই সব পণ্য কে আমরা রেডি করছি রপ্তানির জন্য। দেশের বাইরে আমাদের পণ্যের বিশাল বড় একটা চাহিদা আছে। তা যে শুধু প্রবাসী বাঙ্গালীদের মাঝে তা কিন্তু নয়। অনেক বিদেশিদের মাঝে আমাদের দেশি পণ্য অনেক আকর্ষণীও। আমাদের দেশি খাবার ও। তাই আমরা কয়েকদিন আগেই খাদ্য নিয়ে কাজ করছেন যেসব উদ্যোক্তা, তাদেরকে নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রেতা দের সাথে আমরা ২ দিন ব্যাপী মিটিং করিয়ে দেই। এসব উদ্যোক্তাদের কে শিখানো হচ্ছে রপ্তানির ব্যাপারে সব কিছু।
বাংলাদেশে অনলাইন উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই এখন নারী। এটা অনেক আশার একটি কথা। বর্তমানে ৩০০ থেকে ৩৫০ কোটি টাকার মার্কেট সাইজ হয়েছে আমাদের এফ-কমারস সেক্টর। ২০২১ সালে এটা আরও বাড়বে বলে আমি আশা করছি। তবে এই নাম্বার টা আরও বাড়বে, যদি আমরা প্রান্তিক পর্যায়ের নারীদের সম্পূর্ণ ভাবে এই সেক্টরে নিয়ে আসতে পারি। পাশাপাশি ডেলিভারি সিস্টেম টা ইউনিয়ন পর্যায়ে পৌঁছে দিতে হবে। আর নারীদের আর্থিক সহায়তার জন্য সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি সেক্টর থেকে ও এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমানে প্রায় ৪ লক্ষ নারী অনলাইনে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছে। ২০২১ এ ১০ লক্ষ হয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু না যদি আমরা ঠিক ভাবে উনাদের কে একটু গাইডলাইন দিতে পারি।
এই করোনায় যা ক্ষতি হয়েছে মানুষের, যত প্রান ঝরে গেছে, সেই ক্ষতি অপূরণীয়। সেই সব মানুষ ও আর ফিরে আসবে না। কিন্তু তাও আমাদের চলতে তো হবে। সেই প্রতিকুল অবস্থা কে অনুকুলে এনেই কাজ করে যেতে হবে। সামনের পৃথিবী জানিনা কি হবে, আশা করছি হয়ত নতুন একটা সুন্দর পৃথিবী পাবো আমরা। তার জন্য তৈরি হতে হবে সবাইকে সব হতাশা ঝেরে ফেলে দিয়ে। আমরা সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি।