উদ্যোক্তা শব্দ টা ছোট হতে পারে, কিন্তু এটা অনেক ভারি, এটার অনেক ওজন কিন্তু। অনেক কঠিন একটা জিনিস। তাই কেউ শখের বশে উদ্যোক্তা হতে চাইলে আমি প্রথমেই তাকে না করি। অনেকেই হয়ত ভাবতে পারেন নিশা হয়ত চায়না আমি সামনে এগিয়ে যাই। ব্যাপারটা তা না। নিজের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি এই কথা। উদ্যোক্তা হয়ে উঠার প্রক্রিয়া আছে কিছু। প্রথমেই তাকে মাইন্ডসেট করতে হবে। ভুলে ও চিন্তা করা যাবে না বাজার থেকে কিছু কাপড় কিনে এনে অনলাইনে বিক্রি করে উদ্যোক্তা হয়ে গেলাম। আপনার উদ্যোগের পিছনে কোন একটা উদ্দেশ্য থাকা অবশ্যই উচিত। কোন সোশ্যাল মেসেজ থাকা ভাল। বা কোন সমস্যার সমাধান। আইডিয়া টা হওয়া উচিৎ অন্যদের চাইতে একটু ইউনিক। তার জন্য সবার আগে আপনার মার্কেট টা জরিপ করে দেখা দরকার। জানা দরকার কোন জায়গা টা নিয়ে কাজ করলে আপনার উদ্যোগ টা একটু আলাদা হবে। থাকা দরকার সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা। একটা বিজনেস প্ল্যান করে এগোনো টা খুবি ভাল। পাশাপাশি কিছু কিছু টপিক এর উপর ছোট ছোট কিছু কর্মশালা করে নিতে পারলে ভাল। যেমন ডিজিটাল মার্কেটিং, ফাইনান্স, কাস্টমার মানেজ ইত্যাদি এমন আরও কিছু। এবং সবচেয়ে বড় মাইন্ডসেট এটা যে প্রথম ৬মাস বা ১বছরে এখানে থেকে আমার কোন রিটার্ন আসবে না। অনেক ধৈর্য ধরতে হবে এবং অবশ্যই সৎ থাকতে হবে।
তবে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। মনে একটু সাহস নিয়ে শুরু করা টা অনেক বড় ব্যাপার। উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে গেলে অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকবে, চ্যালেঞ্জ থাকবে, কিন্তু সেটা কে উতরে উঠা তেমন কঠিন কিছু না। নারীদের নানান ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকে। একটা সময় ছিল যখন পরিবারের কাছ থেকে সাপোর্ট পেতনা আমাদের মেয়েরা। এখন কিন্তু সেই জায়গা টা অনেকখানি বদলে গেছে। পরিবার এখন মেয়েদেরকে সাপোর্ট করতে চায়, বরং আমি দেখছি মেয়েরাই হয়ত অনেক সময় সিরিয়াস হয়না। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে। সেই জায়গা থেকে আমাদের মেয়েদের বের হয়ে আসতে হবে।
এর পরের ধাপ টা হল নিজের উদ্যোগকে নিজের স্কিল যেটা নিয়ে ভাল, সেই জায়গা থেকে শুরু করতে হবে। যে ব্যাপারে আপনার জ্ঞান ভাল থাকবে সেটা নিয়ে শুরু করলে ভাল। অথবা আপনার সেই ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই, কিন্তু আগ্রহ আছে অনেক, তাহলে ও আপনি শুরু করতে পারেন। বরং আগ্রহের জায়গা নিয়ে , আবেগের জায়গা নিয়ে শুরু করলে সেই উদ্যোগ টা কে নিয়ে আপনি বহুদুর এগিয়ে যেতে পারবেন। প্রাথমিক ভাবে আপনার ফান্ডিং একটা বড় সমস্যা। সেটার যোগান নিজের জমানো টাকা থেকে হতে পারে। পারিবারিক ভাবে কিছু সাপোর্ট নিতে পারেন। কিন্তু প্রথমেই ভুলে ও ঋণের কথা চিন্তা করবেন না। আর আপনি চাইলে ও উদ্যোগের সাথে সাথেই কোন ব্যাংক বা ব্যক্তি আপনাকে ঋণ দিবে না। তাই প্রথমেই ফান্ডিং এর একটা বেবস্থা করেই নামা উচিৎ।
উদ্যোগ অনলাইনে হোক বা অফলাইনে, আপনাকে অবশ্যই ট্রেড লাইসেন্স করে ফেলা উচিৎ সাথে সাথেই। আর যদি যৌথ মালিকানা থাকে, তাহলে অবশ্যই আরজেএসসি (Registrar of Joint Stock Companies And Firms RJSC) থেকে রেজিস্টার করে ফেলা ভাল। কারন যৌথ মালিকানায় কাগজ পত্র ঠিক না থাকলে ভবিষ্যতে অনেক বেশি ঝামেলার সৃষ্টি হয়। এটাও আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। মনে রাখবেন, যেদিন থেকে আপনি ট্রেড লাইসেন্স করবেন, সেদিন থেকে আপনার উদ্যোগের বয়স ধরা হবে। একজন উদ্যোক্তার জন্য উদ্যোগের বয়স টা অনেক জরুরী একটা বিষয়। কারন আপনি পরবর্তীতে সরকারের কোন সহায়তা পেতে গেলে, ব্যাংক ঋণ নিতে গেলে বা কোন টেন্ডারে অংশ গ্রহন করতে গেলে, প্রতিটি জায়গায় আপনার উদ্যোগের বয়সটি সবার আগে দেখা হবে। তাই উদ্যোগের শুরু তেই এটা করে ফেলা ভাল।
পরবর্তী ধাপ হচ্ছে ব্যাংক একাউন্ট খুলে ফেলা। যে কোন লেনদেন, তা যতই ছোট হোক না কেন, চেষ্টা করবেন ব্যাংকের মাধ্যমে করার জন্য।
এতোক্ষন যা বললাম, তা হচ্ছে প্ল্যান করে উদ্যোক্তা হওয়ার উপায়। কিন্তু এই ২০২০ এ আমাদের দেশে অনলাইনে হাজার হাজার উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে প্ল্যান ছাড়া। কেউ পরিবারকে চালানোর জন্য, কেউ অলস সময়টাকে কাজে লাগানোর জন্য, কেউ বা অফলাইনের ব্যবসাতে বিরাট লস গুনে অনলাইনে এসেছিল, সেখানে থেকে আইডিয়া নিয়ে অনলাইনে উদ্যোক্তা হয়েছে। ঘটনা টা কি জানেন? সেটা হল করোনা। অনেক নারী আছেন, যারা কিনা কখনো ভাবেননি যে তারা কখনো উদ্যোক্তা হবেন। তাদের সংসার মোটামুটি হয়ত ভালই চলছিল। কিন্তু করোনায় অনেকের স্বামীর চাকরি চলে গেল, অনেকের চাকরি থাকলে ও বেতন বন্ধ হয়ে গেল। মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ না খেয়ে থাকবে কিন্তু কখনো কারো কাছে হাত পাততে পারে না। সেই সময় উনারা কোন ভাবে আমাদের ওমেন অ্যান্ড ই-কমারস (উই) গ্রুপে জয়েন করে। সেখানে দেখতে পায় মেয়ে রা দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করছে, যার যা স্কিল আছে সেটা নিয়ে উদ্যোক্তা হচ্ছে। এসব দেখে তখন সেই সব গৃহিণী পরিবার কে বাঁচাতে নিজের রান্নার স্কিল, বা গহনা বানানর স্কিল, বা তেল বানানর স্কিল নিয়ে সামনে আসল। এমন অনেক ধরনের পণ্য আছে যা কিনা আমরা ভুলতে বসেছিলাম, বা নাম ও শুনেনি কখনো আমাদের পরের প্রজন্ম, সেই সব পণ্য নিয়ে মানুষ উদ্যোক্তা হয়ে গেছেন এই করোনা সময়ে।
আমি যদি সেই সময়ের একটু বর্ণনা দেই, তাহলে অনেকের কাছে পরিষ্কার হবে ব্যাপারটা।
কভিড ১৯ ভাইরাস এর জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হল মার্চ মাসে। নামে ছুটি হলে ও টোটাল লকডাউন ছিল তখন। প্রথম কয়েকদিন মানুষের ভিতর ছুটির ভাব থাকলে ও কয়েকদিন পর থেকেই শুরু হয় হতাশা। এর ভিতর এসে পড়ল পহেলা বৈশাখ। বিশাল বড় একটা ধাক্কা খেল আমাদের সব উদ্যোক্তারা।
চিন্তা করে দেখলাম এভাবে চলতে থাকলে তো এরা ডিপ্রেশনেই মারা যাবে। তখন ঠিক করলাম যে আমাদের উই গ্রুপে কারো হতাশা মুলক পোস্ট এপ্প্রুভ করবো না। বরং সবাই কে উৎসাহ দিতে হবে। সবাইকে বলতে লাগলাম আপনারা নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে থাকেন। এটাই সময়। এখন দক্ষতা বৃদ্ধি করলে কয়েক দিন পর লকডাউন শেষ হয়ে গেলে তখন অনেক কাজে দিবে সেটা। এসব নিয়ে আমরা ওয়েবিনার ও করলাম। সবার উৎসাহ অনেক বেড়ে গেল আলহামদুলিল্লাহ। তখন আমরা কিছু ফ্রী স্কিল ডেভেলপমেন্ট এর কাজ হাতে নিলাম। এর ভিতর রোজা এসে পড়ল প্রায়। রোযা এবং ঈদ এর মার্কেট যেন ধ্বস না নামে তার জন্য আমরা ই-ক্যাব (ই কমার্স এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ) এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রানালয় গুলো কে চিঠি দিলাম। তখন ই-কমারস সেক্টরকে আমাদের সরকার ইমারজেন্সি সেক্টর হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা অনুরোধ করলাম সরকারকে যে, ডেলিভারি কোম্পানি গুলো তো বিকেল ৫ টা পর্যন্ত কাজ করছেই, এই করোনায় তারা রিয়াল ফাইটার হয়ে কাজ করছে। উনাদের সার্ভিস টা যদি রাত ১০ টা পর্যন্ত বাড়ানো যেত, এবং আমাদের অনলাইনের উদ্যোক্তাদের কাজ করার
অনুমতি যদি পাওয়া যেত, তাহলে আমাদের উদ্যোক্তারা একটু বাঁচতে পারতো এই সময়টায়। এবং আমাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রানালয় গুলো আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে রাজি হলেন তাতে। এবার আমরা উদ্যোক্তাদের বুঝানো শুরু করলাম যারা খাদ্য নিয়ে কাজ করছেন, তারা রেডি হয়ে যান রোযার ইফতার এবং সেহরির মার্কেট ধরার জন্য। ডেলিভারি চ্যানেল এর লিস্ট আমরা দিব। তখন আমাদের উদ্যোক্তাদের ভিতর শুরু হয়ে গেল কাজ গোছানো। এবং যারা ফ্যাশান নিয়ে কাজ করছেন তাদের কে বুঝালাম যে আপনারা সাথে টেইলারিং সার্ভিস টা শুরু করেন। ঈদে কেউ নিজের জন্য না কিনলে ও নিজের বাবা মা, স্বামী বা সন্তানের জন্য অবশ্যই কিছু কিন্তু চাইবে।
সেই থেকে শুরু। তারপর আমাদের উদ্যোক্তাদের কে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।এই লকডাউনে আমাদের ৩০০ জন উদ্যোক্তা লাখপতি খেতাব পেয়েছে। আমাদের গ্রুপে দেশি পণ্য ছাড়া বিদেশি পণ্য নিয়ে কাজ করতে পারেন না, কেউ গতানুগতিক সেল পোস্ট দিতে পারেনা। এটা আমাদের রুলস এ নেই। তাকে এখানে গল্পের মাধ্যমে সুন্দর করে পোস্ট দিতে হয়, সেই প্রডাক্টের পিছনের ঘটনা গুলো বর্ণনা করে পোস্ট দেয়, এতে করে বাকি সবার ভিতর সেই প্রোডাক্ট বা পণ্য সম্পরকে একটা ধারনা এসে পরে, এবং এক ধরনের বন্ধন তৈরি হয়ে যায় কাস্টমারের সাথে।
তবে, আমার লাভ আজ হচ্ছে, আমি ভাল করছি, কিন্তু কাল লাভ নাও হতে পারে। কাল আমার বিশাল লস হতে পারে। সেটাকে মেনে নেয়ার মানুষিকতা ও থাকতে হবে। অনেক নারী উদ্যোক্তা এভাবে হারিয়ে যায়। হেরে যাওয়া মেনে নিয়ে নতুন করে শুরু করার প্রবনতা আমাদের ভিতর একটু কম।
আমাদের বাংলাদেশ সরকার নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহন বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন রকম বেবস্থা নিয়েছেন। শিশু ও নারী মন্ত্রনালয় থেকে নানান ধরনের ট্রেইনিং এর বেবস্থা ও করা হয়ে থাকে সেখান থেকে। এছাড়া ও আইসিটি মন্ত্রনালয় থেকে আইডিয়ার উপর ভিত্তি করে স্টার্টআপ দের ফান্ডিং করে থাকে, সেখানে নারীদের কে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। তবে সরকারি পর্যায়ে এসব উদ্যোগ আরও বাড়াতে পারলে ভাল। পাশাপাশি বেসরকারি সেক্টর থেকে ও নানান ধরনের সুযোগ সুবিধা আসা উচিত বলে আমি মনে করি।
বর্তমানে এফ-কমারস সেক্টর অনেক জনপ্রিয়, এই পেনডেমিকের ভিতর এফ-কমারস ৩০০ থেকে ৩৫০ কোটি টাকার মার্কেটে পরিনত হয়েছে। এবং এখানে ৬০ শতাংশই নারী উদ্যোক্তা। আই সেক্টরকে যেন আরও বড় করা যায়, তার জন্য নারীদের অংশগ্রহনের পাশাপাশি, নারীদের টিকে থাকার উপর ও অনেক গুরুত্ব আরপ করা উচিৎ। বর্তমান বিশ্ব করোনা কে নিয়ে যেভাবে চলছে, এটাকেই নিউ নরমাল ধরে নিয়ে আমাদের সকল নারীদের কে টিকে থাকার মনোবল বের করে এগিয়ে যেতে হবে।
যাওয়ার আগে আমার পরিচয় দিয়ে যাই। আমি নাসিমা আক্তার নিশা। ওমেন অ্যান্ড ই-কমারস (উই) এর প্রেসিডেন্ট। পাশাপাশি ই-কমারস এসোসিয়েশন এর জয়েন্ট সেক্রেটারি। আমার নিজের ছোট একটা উদ্যোগ আছে, নাম রেভারি কর্পোরেশন। যার কাজ হচ্ছে মোবাইল এর অ্যাপস গেমস সফটওয়্যার বানানো এবং বিভিন্ন টপিক এর উপর ট্রেইনিং দেয়া। দেশের নারী দের নিয়ে কিছু করার উদ্দেশে আমার উই প্লাটফর্ম তৈরি করা। আমি আমার উদ্যোক্তা জীবনে নানান প্রতিকুল অবস্থার মাঝে দিয়ে গিয়েছি, তাই আমার উই তৈরি করা, যেন নারীদের কে সেইসব জায়গা থেকে একটু সাহায্য করতে পারি।
">
উদ্যোক্তা শব্দ টা ছোট হতে পারে, কিন্তু এটা অনেক ভারি, এটার অনেক ওজন কিন্তু। অনেক কঠিন একটা জিনিস। তাই কেউ শখের বশে উদ্যোক্তা হতে চাইলে আমি প্রথমেই তাকে না করি। অনেকেই হয়ত ভাবতে পারেন নিশা হয়ত চায়না আমি সামনে এগিয়ে যাই। ব্যাপারটা তা না। নিজের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি এই কথা। উদ্যোক্তা হয়ে উঠার প্রক্রিয়া আছে কিছু। প্রথমেই তাকে মাইন্ডসেট করতে হবে। ভুলে ও চিন্তা করা যাবে না বাজার থেকে কিছু কাপড় কিনে এনে অনলাইনে বিক্রি করে উদ্যোক্তা হয়ে গেলাম। আপনার উদ্যোগের পিছনে কোন একটা উদ্দেশ্য থাকা অবশ্যই উচিত। কোন সোশ্যাল মেসেজ থাকা ভাল। বা কোন সমস্যার সমাধান। আইডিয়া টা হওয়া উচিৎ অন্যদের চাইতে একটু ইউনিক। তার জন্য সবার আগে আপনার মার্কেট টা জরিপ করে দেখা দরকার। জানা দরকার কোন জায়গা টা নিয়ে কাজ করলে আপনার উদ্যোগ টা একটু আলাদা হবে। থাকা দরকার সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা। একটা বিজনেস প্ল্যান করে এগোনো টা খুবি ভাল। পাশাপাশি কিছু কিছু টপিক এর উপর ছোট ছোট কিছু কর্মশালা করে নিতে পারলে ভাল। যেমন ডিজিটাল মার্কেটিং, ফাইনান্স, কাস্টমার মানেজ ইত্যাদি এমন আরও কিছু। এবং সবচেয়ে বড় মাইন্ডসেট এটা যে প্রথম ৬মাস বা ১বছরে এখানে থেকে আমার কোন রিটার্ন আসবে না। অনেক ধৈর্য ধরতে হবে এবং অবশ্যই সৎ থাকতে হবে।
তবে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। মনে একটু সাহস নিয়ে শুরু করা টা অনেক বড় ব্যাপার। উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে গেলে অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকবে, চ্যালেঞ্জ থাকবে, কিন্তু সেটা কে উতরে উঠা তেমন কঠিন কিছু না। নারীদের নানান ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকে। একটা সময় ছিল যখন পরিবারের কাছ থেকে সাপোর্ট পেতনা আমাদের মেয়েরা। এখন কিন্তু সেই জায়গা টা অনেকখানি বদলে গেছে। পরিবার এখন মেয়েদেরকে সাপোর্ট করতে চায়, বরং আমি দেখছি মেয়েরাই হয়ত অনেক সময় সিরিয়াস হয়না। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে। সেই জায়গা থেকে আমাদের মেয়েদের বের হয়ে আসতে হবে।
এর পরের ধাপ টা হল নিজের উদ্যোগকে নিজের স্কিল যেটা নিয়ে ভাল, সেই জায়গা থেকে শুরু করতে হবে। যে ব্যাপারে আপনার জ্ঞান ভাল থাকবে সেটা নিয়ে শুরু করলে ভাল। অথবা আপনার সেই ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই, কিন্তু আগ্রহ আছে অনেক, তাহলে ও আপনি শুরু করতে পারেন। বরং আগ্রহের জায়গা নিয়ে , আবেগের জায়গা নিয়ে শুরু করলে সেই উদ্যোগ টা কে নিয়ে আপনি বহুদুর এগিয়ে যেতে পারবেন। প্রাথমিক ভাবে আপনার ফান্ডিং একটা বড় সমস্যা। সেটার যোগান নিজের জমানো টাকা থেকে হতে পারে। পারিবারিক ভাবে কিছু সাপোর্ট নিতে পারেন। কিন্তু প্রথমেই ভুলে ও ঋণের কথা চিন্তা করবেন না। আর আপনি চাইলে ও উদ্যোগের সাথে সাথেই কোন ব্যাংক বা ব্যক্তি আপনাকে ঋণ দিবে না। তাই প্রথমেই ফান্ডিং এর একটা বেবস্থা করেই নামা উচিৎ।
উদ্যোগ অনলাইনে হোক বা অফলাইনে, আপনাকে অবশ্যই ট্রেড লাইসেন্স করে ফেলা উচিৎ সাথে সাথেই। আর যদি যৌথ মালিকানা থাকে, তাহলে অবশ্যই আরজেএসসি (Registrar of Joint Stock Companies And Firms RJSC) থেকে রেজিস্টার করে ফেলা ভাল। কারন যৌথ মালিকানায় কাগজ পত্র ঠিক না থাকলে ভবিষ্যতে অনেক বেশি ঝামেলার সৃষ্টি হয়। এটাও আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। মনে রাখবেন, যেদিন থেকে আপনি ট্রেড লাইসেন্স করবেন, সেদিন থেকে আপনার উদ্যোগের বয়স ধরা হবে। একজন উদ্যোক্তার জন্য উদ্যোগের বয়স টা অনেক জরুরী একটা বিষয়। কারন আপনি পরবর্তীতে সরকারের কোন সহায়তা পেতে গেলে, ব্যাংক ঋণ নিতে গেলে বা কোন টেন্ডারে অংশ গ্রহন করতে গেলে, প্রতিটি জায়গায় আপনার উদ্যোগের বয়সটি সবার আগে দেখা হবে। তাই উদ্যোগের শুরু তেই এটা করে ফেলা ভাল।
পরবর্তী ধাপ হচ্ছে ব্যাংক একাউন্ট খুলে ফেলা। যে কোন লেনদেন, তা যতই ছোট হোক না কেন, চেষ্টা করবেন ব্যাংকের মাধ্যমে করার জন্য।
এতোক্ষন যা বললাম, তা হচ্ছে প্ল্যান করে উদ্যোক্তা হওয়ার উপায়। কিন্তু এই ২০২০ এ আমাদের দেশে অনলাইনে হাজার হাজার উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে প্ল্যান ছাড়া। কেউ পরিবারকে চালানোর জন্য, কেউ অলস সময়টাকে কাজে লাগানোর জন্য, কেউ বা অফলাইনের ব্যবসাতে বিরাট লস গুনে অনলাইনে এসেছিল, সেখানে থেকে আইডিয়া নিয়ে অনলাইনে উদ্যোক্তা হয়েছে। ঘটনা টা কি জানেন? সেটা হল করোনা। অনেক নারী আছেন, যারা কিনা কখনো ভাবেননি যে তারা কখনো উদ্যোক্তা হবেন। তাদের সংসার মোটামুটি হয়ত ভালই চলছিল। কিন্তু করোনায় অনেকের স্বামীর চাকরি চলে গেল, অনেকের চাকরি থাকলে ও বেতন বন্ধ হয়ে গেল। মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ না খেয়ে থাকবে কিন্তু কখনো কারো কাছে হাত পাততে পারে না। সেই সময় উনারা কোন ভাবে আমাদের ওমেন অ্যান্ড ই-কমারস (উই) গ্রুপে জয়েন করে। সেখানে দেখতে পায় মেয়ে রা দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করছে, যার যা স্কিল আছে সেটা নিয়ে উদ্যোক্তা হচ্ছে। এসব দেখে তখন সেই সব গৃহিণী পরিবার কে বাঁচাতে নিজের রান্নার স্কিল, বা গহনা বানানর স্কিল, বা তেল বানানর স্কিল নিয়ে সামনে আসল। এমন অনেক ধরনের পণ্য আছে যা কিনা আমরা ভুলতে বসেছিলাম, বা নাম ও শুনেনি কখনো আমাদের পরের প্রজন্ম, সেই সব পণ্য নিয়ে মানুষ উদ্যোক্তা হয়ে গেছেন এই করোনা সময়ে।
আমি যদি সেই সময়ের একটু বর্ণনা দেই, তাহলে অনেকের কাছে পরিষ্কার হবে ব্যাপারটা।
কভিড ১৯ ভাইরাস এর জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হল মার্চ মাসে। নামে ছুটি হলে ও টোটাল লকডাউন ছিল তখন। প্রথম কয়েকদিন মানুষের ভিতর ছুটির ভাব থাকলে ও কয়েকদিন পর থেকেই শুরু হয় হতাশা। এর ভিতর এসে পড়ল পহেলা বৈশাখ। বিশাল বড় একটা ধাক্কা খেল আমাদের সব উদ্যোক্তারা।
চিন্তা করে দেখলাম এভাবে চলতে থাকলে তো এরা ডিপ্রেশনেই মারা যাবে। তখন ঠিক করলাম যে আমাদের উই গ্রুপে কারো হতাশা মুলক পোস্ট এপ্প্রুভ করবো না। বরং সবাই কে উৎসাহ দিতে হবে। সবাইকে বলতে লাগলাম আপনারা নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে থাকেন। এটাই সময়। এখন দক্ষতা বৃদ্ধি করলে কয়েক দিন পর লকডাউন শেষ হয়ে গেলে তখন অনেক কাজে দিবে সেটা। এসব নিয়ে আমরা ওয়েবিনার ও করলাম। সবার উৎসাহ অনেক বেড়ে গেল আলহামদুলিল্লাহ। তখন আমরা কিছু ফ্রী স্কিল ডেভেলপমেন্ট এর কাজ হাতে নিলাম। এর ভিতর রোজা এসে পড়ল প্রায়। রোযা এবং ঈদ এর মার্কেট যেন ধ্বস না নামে তার জন্য আমরা ই-ক্যাব (ই কমার্স এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ) এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রানালয় গুলো কে চিঠি দিলাম। তখন ই-কমারস সেক্টরকে আমাদের সরকার ইমারজেন্সি সেক্টর হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা অনুরোধ করলাম সরকারকে যে, ডেলিভারি কোম্পানি গুলো তো বিকেল ৫ টা পর্যন্ত কাজ করছেই, এই করোনায় তারা রিয়াল ফাইটার হয়ে কাজ করছে। উনাদের সার্ভিস টা যদি রাত ১০ টা পর্যন্ত বাড়ানো যেত, এবং আমাদের অনলাইনের উদ্যোক্তাদের কাজ করার
অনুমতি যদি পাওয়া যেত, তাহলে আমাদের উদ্যোক্তারা একটু বাঁচতে পারতো এই সময়টায়। এবং আমাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রানালয় গুলো আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে রাজি হলেন তাতে। এবার আমরা উদ্যোক্তাদের বুঝানো শুরু করলাম যারা খাদ্য নিয়ে কাজ করছেন, তারা রেডি হয়ে যান রোযার ইফতার এবং সেহরির মার্কেট ধরার জন্য। ডেলিভারি চ্যানেল এর লিস্ট আমরা দিব। তখন আমাদের উদ্যোক্তাদের ভিতর শুরু হয়ে গেল কাজ গোছানো। এবং যারা ফ্যাশান নিয়ে কাজ করছেন তাদের কে বুঝালাম যে আপনারা সাথে টেইলারিং সার্ভিস টা শুরু করেন। ঈদে কেউ নিজের জন্য না কিনলে ও নিজের বাবা মা, স্বামী বা সন্তানের জন্য অবশ্যই কিছু কিন্তু চাইবে।
সেই থেকে শুরু। তারপর আমাদের উদ্যোক্তাদের কে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।এই লকডাউনে আমাদের ৩০০ জন উদ্যোক্তা লাখপতি খেতাব পেয়েছে। আমাদের গ্রুপে দেশি পণ্য ছাড়া বিদেশি পণ্য নিয়ে কাজ করতে পারেন না, কেউ গতানুগতিক সেল পোস্ট দিতে পারেনা। এটা আমাদের রুলস এ নেই। তাকে এখানে গল্পের মাধ্যমে সুন্দর করে পোস্ট দিতে হয়, সেই প্রডাক্টের পিছনের ঘটনা গুলো বর্ণনা করে পোস্ট দেয়, এতে করে বাকি সবার ভিতর সেই প্রোডাক্ট বা পণ্য সম্পরকে একটা ধারনা এসে পরে, এবং এক ধরনের বন্ধন তৈরি হয়ে যায় কাস্টমারের সাথে।
তবে, আমার লাভ আজ হচ্ছে, আমি ভাল করছি, কিন্তু কাল লাভ নাও হতে পারে। কাল আমার বিশাল লস হতে পারে। সেটাকে মেনে নেয়ার মানুষিকতা ও থাকতে হবে। অনেক নারী উদ্যোক্তা এভাবে হারিয়ে যায়। হেরে যাওয়া মেনে নিয়ে নতুন করে শুরু করার প্রবনতা আমাদের ভিতর একটু কম।
আমাদের বাংলাদেশ সরকার নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহন বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন রকম বেবস্থা নিয়েছেন। শিশু ও নারী মন্ত্রনালয় থেকে নানান ধরনের ট্রেইনিং এর বেবস্থা ও করা হয়ে থাকে সেখান থেকে। এছাড়া ও আইসিটি মন্ত্রনালয় থেকে আইডিয়ার উপর ভিত্তি করে স্টার্টআপ দের ফান্ডিং করে থাকে, সেখানে নারীদের কে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। তবে সরকারি পর্যায়ে এসব উদ্যোগ আরও বাড়াতে পারলে ভাল। পাশাপাশি বেসরকারি সেক্টর থেকে ও নানান ধরনের সুযোগ সুবিধা আসা উচিত বলে আমি মনে করি।
বর্তমানে এফ-কমারস সেক্টর অনেক জনপ্রিয়, এই পেনডেমিকের ভিতর এফ-কমারস ৩০০ থেকে ৩৫০ কোটি টাকার মার্কেটে পরিনত হয়েছে। এবং এখানে ৬০ শতাংশই নারী উদ্যোক্তা। আই সেক্টরকে যেন আরও বড় করা যায়, তার জন্য নারীদের অংশগ্রহনের পাশাপাশি, নারীদের টিকে থাকার উপর ও অনেক গুরুত্ব আরপ করা উচিৎ। বর্তমান বিশ্ব করোনা কে নিয়ে যেভাবে চলছে, এটাকেই নিউ নরমাল ধরে নিয়ে আমাদের সকল নারীদের কে টিকে থাকার মনোবল বের করে এগিয়ে যেতে হবে।
যাওয়ার আগে আমার পরিচয় দিয়ে যাই। আমি নাসিমা আক্তার নিশা। ওমেন অ্যান্ড ই-কমারস (উই) এর প্রেসিডেন্ট। পাশাপাশি ই-কমারস এসোসিয়েশন এর জয়েন্ট সেক্রেটারি। আমার নিজের ছোট একটা উদ্যোগ আছে, নাম রেভারি কর্পোরেশন। যার কাজ হচ্ছে মোবাইল এর অ্যাপস গেমস সফটওয়্যার বানানো এবং বিভিন্ন টপিক এর উপর ট্রেইনিং দেয়া। দেশের নারী দের নিয়ে কিছু করার উদ্দেশে আমার উই প্লাটফর্ম তৈরি করা। আমি আমার উদ্যোক্তা জীবনে নানান প্রতিকুল অবস্থার মাঝে দিয়ে গিয়েছি, তাই আমার উই তৈরি করা, যেন নারীদের কে সেইসব জায়গা থেকে একটু সাহায্য করতে পারি।
উদ্যোক্তা শব্দ টা ছোট হতে পারে, কিন্তু এটা অনেক ভারি, এটার অনেক ওজন কিন্তু। অনেক কঠিন একটা জিনিস। তাই কেউ শখের বশে উদ্যোক্তা হতে চাইলে আমি প্রথমেই তাকে না করি। অনেকেই হয়ত ভাবতে পারেন নিশা হয়ত চায়না আমি সামনে এগিয়ে যাই। ব্যাপারটা তা না। নিজের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি এই কথা। উদ্যোক্তা হয়ে উঠার প্রক্রিয়া আছে কিছু। প্রথমেই তাকে মাইন্ডসেট করতে হবে। ভুলে ও চিন্তা করা যাবে না বাজার থেকে কিছু কাপড় কিনে এনে অনলাইনে বিক্রি করে উদ্যোক্তা হয়ে গেলাম। আপনার উদ্যোগের পিছনে কোন একটা উদ্দেশ্য থাকা অবশ্যই উচিত। কোন সোশ্যাল মেসেজ থাকা ভাল। বা কোন সমস্যার সমাধান। আইডিয়া টা হওয়া উচিৎ অন্যদের চাইতে একটু ইউনিক। তার জন্য সবার আগে আপনার মার্কেট টা জরিপ করে দেখা দরকার। জানা দরকার কোন জায়গা টা নিয়ে কাজ করলে আপনার উদ্যোগ টা একটু আলাদা হবে। থাকা দরকার সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা। একটা বিজনেস প্ল্যান করে এগোনো টা খুবি ভাল। পাশাপাশি কিছু কিছু টপিক এর উপর ছোট ছোট কিছু কর্মশালা করে নিতে পারলে ভাল। যেমন ডিজিটাল মার্কেটিং, ফাইনান্স, কাস্টমার মানেজ ইত্যাদি এমন আরও কিছু। এবং সবচেয়ে বড় মাইন্ডসেট এটা যে প্রথম ৬মাস বা ১বছরে এখানে থেকে আমার কোন রিটার্ন আসবে না। অনেক ধৈর্য ধরতে হবে এবং অবশ্যই সৎ থাকতে হবে।
তবে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। মনে একটু সাহস নিয়ে শুরু করা টা অনেক বড় ব্যাপার। উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে গেলে অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকবে, চ্যালেঞ্জ থাকবে, কিন্তু সেটা কে উতরে উঠা তেমন কঠিন কিছু না। নারীদের নানান ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকে। একটা সময় ছিল যখন পরিবারের কাছ থেকে সাপোর্ট পেতনা আমাদের মেয়েরা। এখন কিন্তু সেই জায়গা টা অনেকখানি বদলে গেছে। পরিবার এখন মেয়েদেরকে সাপোর্ট করতে চায়, বরং আমি দেখছি মেয়েরাই হয়ত অনেক সময় সিরিয়াস হয়না। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে। সেই জায়গা থেকে আমাদের মেয়েদের বের হয়ে আসতে হবে।
এর পরের ধাপ টা হল নিজের উদ্যোগকে নিজের স্কিল যেটা নিয়ে ভাল, সেই জায়গা থেকে শুরু করতে হবে। যে ব্যাপারে আপনার জ্ঞান ভাল থাকবে সেটা নিয়ে শুরু করলে ভাল। অথবা আপনার সেই ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই, কিন্তু আগ্রহ আছে অনেক, তাহলে ও আপনি শুরু করতে পারেন। বরং আগ্রহের জায়গা নিয়ে , আবেগের জায়গা নিয়ে শুরু করলে সেই উদ্যোগ টা কে নিয়ে আপনি বহুদুর এগিয়ে যেতে পারবেন। প্রাথমিক ভাবে আপনার ফান্ডিং একটা বড় সমস্যা। সেটার যোগান নিজের জমানো টাকা থেকে হতে পারে। পারিবারিক ভাবে কিছু সাপোর্ট নিতে পারেন। কিন্তু প্রথমেই ভুলে ও ঋণের কথা চিন্তা করবেন না। আর আপনি চাইলে ও উদ্যোগের সাথে সাথেই কোন ব্যাংক বা ব্যক্তি আপনাকে ঋণ দিবে না। তাই প্রথমেই ফান্ডিং এর একটা বেবস্থা করেই নামা উচিৎ।
উদ্যোগ অনলাইনে হোক বা অফলাইনে, আপনাকে অবশ্যই ট্রেড লাইসেন্স করে ফেলা উচিৎ সাথে সাথেই। আর যদি যৌথ মালিকানা থাকে, তাহলে অবশ্যই আরজেএসসি (Registrar of Joint Stock Companies And Firms RJSC) থেকে রেজিস্টার করে ফেলা ভাল। কারন যৌথ মালিকানায় কাগজ পত্র ঠিক না থাকলে ভবিষ্যতে অনেক বেশি ঝামেলার সৃষ্টি হয়। এটাও আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। মনে রাখবেন, যেদিন থেকে আপনি ট্রেড লাইসেন্স করবেন, সেদিন থেকে আপনার উদ্যোগের বয়স ধরা হবে। একজন উদ্যোক্তার জন্য উদ্যোগের বয়স টা অনেক জরুরী একটা বিষয়। কারন আপনি পরবর্তীতে সরকারের কোন সহায়তা পেতে গেলে, ব্যাংক ঋণ নিতে গেলে বা কোন টেন্ডারে অংশ গ্রহন করতে গেলে, প্রতিটি জায়গায় আপনার উদ্যোগের বয়সটি সবার আগে দেখা হবে। তাই উদ্যোগের শুরু তেই এটা করে ফেলা ভাল।
পরবর্তী ধাপ হচ্ছে ব্যাংক একাউন্ট খুলে ফেলা। যে কোন লেনদেন, তা যতই ছোট হোক না কেন, চেষ্টা করবেন ব্যাংকের মাধ্যমে করার জন্য।
এতোক্ষন যা বললাম, তা হচ্ছে প্ল্যান করে উদ্যোক্তা হওয়ার উপায়। কিন্তু এই ২০২০ এ আমাদের দেশে অনলাইনে হাজার হাজার উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে প্ল্যান ছাড়া। কেউ পরিবারকে চালানোর জন্য, কেউ অলস সময়টাকে কাজে লাগানোর জন্য, কেউ বা অফলাইনের ব্যবসাতে বিরাট লস গুনে অনলাইনে এসেছিল, সেখানে থেকে আইডিয়া নিয়ে অনলাইনে উদ্যোক্তা হয়েছে। ঘটনা টা কি জানেন? সেটা হল করোনা। অনেক নারী আছেন, যারা কিনা কখনো ভাবেননি যে তারা কখনো উদ্যোক্তা হবেন। তাদের সংসার মোটামুটি হয়ত ভালই চলছিল। কিন্তু করোনায় অনেকের স্বামীর চাকরি চলে গেল, অনেকের চাকরি থাকলে ও বেতন বন্ধ হয়ে গেল। মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ না খেয়ে থাকবে কিন্তু কখনো কারো কাছে হাত পাততে পারে না। সেই সময় উনারা কোন ভাবে আমাদের ওমেন অ্যান্ড ই-কমারস (উই) গ্রুপে জয়েন করে। সেখানে দেখতে পায় মেয়ে রা দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করছে, যার যা স্কিল আছে সেটা নিয়ে উদ্যোক্তা হচ্ছে। এসব দেখে তখন সেই সব গৃহিণী পরিবার কে বাঁচাতে নিজের রান্নার স্কিল, বা গহনা বানানর স্কিল, বা তেল বানানর স্কিল নিয়ে সামনে আসল। এমন অনেক ধরনের পণ্য আছে যা কিনা আমরা ভুলতে বসেছিলাম, বা নাম ও শুনেনি কখনো আমাদের পরের প্রজন্ম, সেই সব পণ্য নিয়ে মানুষ উদ্যোক্তা হয়ে গেছেন এই করোনা সময়ে।
আমি যদি সেই সময়ের একটু বর্ণনা দেই, তাহলে অনেকের কাছে পরিষ্কার হবে ব্যাপারটা।
কভিড ১৯ ভাইরাস এর জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হল মার্চ মাসে। নামে ছুটি হলে ও টোটাল লকডাউন ছিল তখন। প্রথম কয়েকদিন মানুষের ভিতর ছুটির ভাব থাকলে ও কয়েকদিন পর থেকেই শুরু হয় হতাশা। এর ভিতর এসে পড়ল পহেলা বৈশাখ। বিশাল বড় একটা ধাক্কা খেল আমাদের সব উদ্যোক্তারা।
চিন্তা করে দেখলাম এভাবে চলতে থাকলে তো এরা ডিপ্রেশনেই মারা যাবে। তখন ঠিক করলাম যে আমাদের উই গ্রুপে কারো হতাশা মুলক পোস্ট এপ্প্রুভ করবো না। বরং সবাই কে উৎসাহ দিতে হবে। সবাইকে বলতে লাগলাম আপনারা নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে থাকেন। এটাই সময়। এখন দক্ষতা বৃদ্ধি করলে কয়েক দিন পর লকডাউন শেষ হয়ে গেলে তখন অনেক কাজে দিবে সেটা। এসব নিয়ে আমরা ওয়েবিনার ও করলাম। সবার উৎসাহ অনেক বেড়ে গেল আলহামদুলিল্লাহ। তখন আমরা কিছু ফ্রী স্কিল ডেভেলপমেন্ট এর কাজ হাতে নিলাম। এর ভিতর রোজা এসে পড়ল প্রায়। রোযা এবং ঈদ এর মার্কেট যেন ধ্বস না নামে তার জন্য আমরা ই-ক্যাব (ই কমার্স এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ) এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রানালয় গুলো কে চিঠি দিলাম। তখন ই-কমারস সেক্টরকে আমাদের সরকার ইমারজেন্সি সেক্টর হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা অনুরোধ করলাম সরকারকে যে, ডেলিভারি কোম্পানি গুলো তো বিকেল ৫ টা পর্যন্ত কাজ করছেই, এই করোনায় তারা রিয়াল ফাইটার হয়ে কাজ করছে। উনাদের সার্ভিস টা যদি রাত ১০ টা পর্যন্ত বাড়ানো যেত, এবং আমাদের অনলাইনের উদ্যোক্তাদের কাজ করার
অনুমতি যদি পাওয়া যেত, তাহলে আমাদের উদ্যোক্তারা একটু বাঁচতে পারতো এই সময়টায়। এবং আমাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রানালয় গুলো আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে রাজি হলেন তাতে। এবার আমরা উদ্যোক্তাদের বুঝানো শুরু করলাম যারা খাদ্য নিয়ে কাজ করছেন, তারা রেডি হয়ে যান রোযার ইফতার এবং সেহরির মার্কেট ধরার জন্য। ডেলিভারি চ্যানেল এর লিস্ট আমরা দিব। তখন আমাদের উদ্যোক্তাদের ভিতর শুরু হয়ে গেল কাজ গোছানো। এবং যারা ফ্যাশান নিয়ে কাজ করছেন তাদের কে বুঝালাম যে আপনারা সাথে টেইলারিং সার্ভিস টা শুরু করেন। ঈদে কেউ নিজের জন্য না কিনলে ও নিজের বাবা মা, স্বামী বা সন্তানের জন্য অবশ্যই কিছু কিন্তু চাইবে।
সেই থেকে শুরু। তারপর আমাদের উদ্যোক্তাদের কে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।এই লকডাউনে আমাদের ৩০০ জন উদ্যোক্তা লাখপতি খেতাব পেয়েছে। আমাদের গ্রুপে দেশি পণ্য ছাড়া বিদেশি পণ্য নিয়ে কাজ করতে পারেন না, কেউ গতানুগতিক সেল পোস্ট দিতে পারেনা। এটা আমাদের রুলস এ নেই। তাকে এখানে গল্পের মাধ্যমে সুন্দর করে পোস্ট দিতে হয়, সেই প্রডাক্টের পিছনের ঘটনা গুলো বর্ণনা করে পোস্ট দেয়, এতে করে বাকি সবার ভিতর সেই প্রোডাক্ট বা পণ্য সম্পরকে একটা ধারনা এসে পরে, এবং এক ধরনের বন্ধন তৈরি হয়ে যায় কাস্টমারের সাথে।
তবে, আমার লাভ আজ হচ্ছে, আমি ভাল করছি, কিন্তু কাল লাভ নাও হতে পারে। কাল আমার বিশাল লস হতে পারে। সেটাকে মেনে নেয়ার মানুষিকতা ও থাকতে হবে। অনেক নারী উদ্যোক্তা এভাবে হারিয়ে যায়। হেরে যাওয়া মেনে নিয়ে নতুন করে শুরু করার প্রবনতা আমাদের ভিতর একটু কম।
আমাদের বাংলাদেশ সরকার নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহন বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন রকম বেবস্থা নিয়েছেন। শিশু ও নারী মন্ত্রনালয় থেকে নানান ধরনের ট্রেইনিং এর বেবস্থা ও করা হয়ে থাকে সেখান থেকে। এছাড়া ও আইসিটি মন্ত্রনালয় থেকে আইডিয়ার উপর ভিত্তি করে স্টার্টআপ দের ফান্ডিং করে থাকে, সেখানে নারীদের কে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। তবে সরকারি পর্যায়ে এসব উদ্যোগ আরও বাড়াতে পারলে ভাল। পাশাপাশি বেসরকারি সেক্টর থেকে ও নানান ধরনের সুযোগ সুবিধা আসা উচিত বলে আমি মনে করি।
বর্তমানে এফ-কমারস সেক্টর অনেক জনপ্রিয়, এই পেনডেমিকের ভিতর এফ-কমারস ৩০০ থেকে ৩৫০ কোটি টাকার মার্কেটে পরিনত হয়েছে। এবং এখানে ৬০ শতাংশই নারী উদ্যোক্তা। আই সেক্টরকে যেন আরও বড় করা যায়, তার জন্য নারীদের অংশগ্রহনের পাশাপাশি, নারীদের টিকে থাকার উপর ও অনেক গুরুত্ব আরপ করা উচিৎ। বর্তমান বিশ্ব করোনা কে নিয়ে যেভাবে চলছে, এটাকেই নিউ নরমাল ধরে নিয়ে আমাদের সকল নারীদের কে টিকে থাকার মনোবল বের করে এগিয়ে যেতে হবে।
যাওয়ার আগে আমার পরিচয় দিয়ে যাই। আমি নাসিমা আক্তার নিশা। ওমেন অ্যান্ড ই-কমারস (উই) এর প্রেসিডেন্ট। পাশাপাশি ই-কমারস এসোসিয়েশন এর জয়েন্ট সেক্রেটারি। আমার নিজের ছোট একটা উদ্যোগ আছে, নাম রেভারি কর্পোরেশন। যার কাজ হচ্ছে মোবাইল এর অ্যাপস গেমস সফটওয়্যার বানানো এবং বিভিন্ন টপিক এর উপর ট্রেইনিং দেয়া। দেশের নারী দের নিয়ে কিছু করার উদ্দেশে আমার উই প্লাটফর্ম তৈরি করা। আমি আমার উদ্যোক্তা জীবনে নানান প্রতিকুল অবস্থার মাঝে দিয়ে গিয়েছি, তাই আমার উই তৈরি করা, যেন নারীদের কে সেইসব জায়গা থেকে একটু সাহায্য করতে পারি।